আমাদের একজন জীবন্ত কিংবদন্তি বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম
শাহ আবদুল করিম | বাউল সাধক সংগীত শিল্পী
![]() |
ছবিঃ শাহ আবদুল করিম |
শাহ আবদুল করিম 'আফতাব-উন-নেসা'কে বিয়ে করেন, যাকে তিনি 'সরলা' নামে ডাকতেন। সরলাকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সরলা না থাকলে আমি বাউল শাহ আব্দুল করিম হতে পারতাম না। সরলা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। আমার বাউল জীবনের মুর্শিদজ্ঞান সরলা।’ তিনি ১৯৫৭ সাল থেকে তার জন্মগ্রামের পাশে উজানধল গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। এ সময় তিনি গুরুদের সঙ্গে বর্ষা মৌসুমে হাওড় অঞ্চলে গান গেয়ে বেড়াতেন।
শাকুর মজিদ তাকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন ভাটির পুরুষ নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র। এছাড়াও সুবচন নাট্য সংসদ তাঁকে নিয়ে শাকুর মজিদের লেখা মহাজনের নাও নাটকের ১০৭টি প্রদর্শনী করেছে। শাহ আবদুল করিমের প্রাপ্ত অন্যান্য সম্মাননা হলো— কথা সাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরী পদক (২০০০), রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার (২০০০), লেবাক অ্যাওয়ার্ড (২০০৩), মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার আজীবন সম্মাননা (২০০৪), সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস আজীবন সম্মাননা (২০০৫), বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা (২০০৬), খান বাহাদুর এহিয়া পদক (২০০৮), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা (২০০৮), হাতিল অ্যাওয়ার্ড (২০০৯), এনসিসি ব্যাংক এনএ সম্মাননা (২০০৯)।
প্রখ্যাত শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য একবার বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন-"মানুষ আপনার গান বিকৃত সুরে গায়। আপনার সুর ছাড়া অন্য সুরে গায়। অনেকে আপনার নামটা পর্যন্ত বলে না। এসব দেখতে আপনার খারাপ লাগে না...?"
শাহ্ আবদুল করিম বললেন-
"কথা বোঝা গেলেই হইল... আমার আর কিচ্ছু দরকার নাই..."
কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য আশ্চর্য হয়ে বললেন-
"আপনার সৃষ্টি... আপনার গান। মানুষ আপনার সামনে বিকৃত করে গাইবে। আপনি কিছুই মনে করবেন না... এটা কোন কথা... এটার কোন অর্থ আছে...?"
শাহ্ আবদুল করিম বললেন-
"তুমি তো গান গাও... আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো... ধর তোমাকে একটা অনুষ্ঠানে ডাকা হলো। হাজার হাজার চেয়ার রাখা আছে কিন্তু গান শুনতে কোন মানুষ আসে নাই। শুধু সামনের সারিতে একটা মানুষ বসে আছে... গাইতে পারবে...? "
কালীপ্রসাদ কিছুক্ষন ভেবে উত্তর দিলেন-
"না... পারবো না..."
শাহ্ আবদুল করীম হেসে বললেন-
"আমি পারবো... কারণ আমার গানটার ভেতর দিয়ে আমি একটা আদর্শকে প্রচার করতে চাই। সেটা একজন মানুষের কাছে হলেও। সুর না থাকুক... নাম না থাকুক... সেই আদর্শটা থাকলেই হলো। আর কিছু দরকার নাই... সেজন্যই বললাম শুধু গানের কথা বোঝা গেলেই আমি খুশি..."
কালীপ্রসাদ ভট্টাচার্য জানতে চাইলেই-
"সেই আদর্শটা কি...?"
শাহ আবদুল করীম আবার হেসে বললেন-
"একদিন এই পৃথিবীটা বাউলের পৃথিবী হবে...
এভাবে শাহ আবদুল করিমের স্মৃতিচারণ করেছিলেন কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য এবং আরও বলেছিলেন যে, উনার চোখে যে বিশ্বাস, মানে যুগ যুগ ধরে... আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, আমাদের দেশের কোনো রাষ্ট্রপতি কোনো প্রধানমন্ত্রীর চোখে এই বিশ্বাস নেই।... আমরা অনেক নেতাদের মুখে অনেক কথা শুনি, কিন্তু তারা বিশ্বাসে বলেন না কথাগুলো। তারা বলতে হয় বলে বলেন, নয় নিজের স্বার্থে বলেন, নয় লোককে ভুল বুঝানোর জন্য বলেন।”
একবার সুনামগঞ্জে তাকে সংবর্ধনা দেয়ার কথা। প্রোগ্রামের শেষের দিকে মাইকে ঘোষণা আসলো, এবারে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের হাতে তুলে দেওয়া হবে তিন লাখ টাকার সম্মাননা চেক।
আব্দুল করিম বার্ধক্যে উপনীত। তিনি বোধহয় কানে ভুল শুনলেন। তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। তিনি পাশে বসে থাকা তার একমাত্র সন্তান জালালকে বললেন, জালাল ইতা কিতা কয়! তিন হাজার টাকা! এ তো অনেক টাকা! এত টাকা দিয়ে আমি কি করতাম!
আব্দুল করিমকে আস্তে করে জানানো হলো, তিন হাজার নয়, টাকার অংকটা তিন লাখ! শাহ আব্দুল করিম অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি হতভম্ব। তিনি বললেন, তিন লাখ? সর্বনাশ, অত টাকা! এগুলো নিয়্যা আমরা কিতা করমু? আমরার টাকার দরকার নাই, মানুষ যে ভালোবাসা দিছে, সেইটাই বড় প্রাপ্তি। চল চল বাড়ি চল। বলেই তিনি বেরিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন।
একজন মানুষ কতটা আর নির্লোভ হতে পারেন! শাহ আবদুল করিম ছিলেন এমন ই একজন নিঃস্বার্থ, নির্লোভ প্রকৃতির মানুষ!
দেশের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সাথে সম্পর্কের অবনতি নিয়ে শাহ আবদুল করিম বলেন, 'হুমায়ূন সাহেব অত্যন্ত জ্ঞানী-গুণী মানুষ। আমি তাঁকে শ্রদ্ধাও করি। আমাকেও তিনি শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেন। একবার তিনি টিভিতে একটি অনুষ্ঠান বানানোর জন্য একজন লোককে আমার কাছে পাঠালেন। প্রচার আমি কোনোসময়ই চাইনি, তখনো তা-ই করেছিলাম। কিন্তু লোকটির চাপাচাপিতে ঢাকা গেলাম। হুমায়ূন সাহেব আমার সাক্ষাত্কার নেওয়ালেন, গান গাওয়ালেন। আমি ফিরে আসার সময় উনি সৌজন্যসাক্ষাত্টুকু পর্যন্ত করলেন না, গাড়ির ড্রাইভারকে দিয়ে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিলেন। আমার হাসি পেল। এই টাকার জন্য কি আমি এতদূর ঢাকা ছুটে গিয়েছিলাম? আমি হাওরের বনে-বাদাড়ে বড় হয়েছি, মনটা সে রকমই বড়। টাকা আমার কাছে কিছুই না। এই করিম টাকার ধান্ধা করলে এতদিনে অনেক বড়লোক হতে পারত! কই, কখনো তো টাকার পেছনে ছুটিনি। এ ঘটনাটি আমাকে খুব পীড়া দেয়। পরে অনুষ্ঠানটি প্রচারের তারিখও তিনি আমাকে জানাননি। সে ঘটনাই আমি সাক্ষাত্কারে বলেছিলাম। পরে আর কখনো হুমায়ূন আহমদের কাছে যাইনি। সত্য কথা বলার কারণে যদি সম্পর্কের অবনতি হয়ে থাকে—তাতে তো আমার আর কিছুই করার নাই।'
ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মানবোধ কাকে বলে বাউল দেখিয়ে গিয়েছেন।
তিনি একবার বলেছিলেন, 'এত সংবর্ধনা, সম্মান দিয়ে আমার কী হবে? সংবর্ধনা বিক্রি করে দিরাই বাজারে এক সের চালও কেনা যায় না। পেটে যদি ভাত না থাকে করিম মেডেল গলায় দিয়ে কী করবে?'
স্পষ্টতায়, স্পর্ধায় কাটিয়েছেন এক বাউল জীবন।
"এই করিমকে মানুষ তখন খুঁজে পাবে শুধুই গানে আর সুরে" - তাঁর বিভিন্ন গানের সারমর্ম বা তত্ত্ব নিয়ে বলেছিলেন শাহ আবদুল করিম নিজেই। আসলেই তিনি সঠিক কথাটাই বলে গিয়েছিলেন এই বাউল সাধক। মানুষ ঠিকই তাঁকে খুঁজে তাঁর গানে আর সুরে। শত বছর পেরিয়েও এখনো কত সমকালীন ও প্রাসঙ্গিক তাঁর গান, সুর আর দর্শন। গ্রামের বাজারের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে মফস্বল শহরে কিংবা গাছের নিচের বাঁশের মাচা কিংবা পাঁচ তারকা হোটেলের লবি বয়স্ক কিংবা বর্তমান তরুণ প্রজন্মদের হুটহাট আড্ডায় বা ট্যুরে পাহাড়ে-সমদ্র তীড়ে, গ্রাম কিংবা আধুনিক শহর- সর্বত্র সব প্রজন্মের কাছেই আছে উনার লেখা আর সুর করা গানের উপস্থিতি। এজন্যই তিনি এক ব্যতিক্রমী বাউল, বাউল সংগীতকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। এজন্যই তিনি প্রজন্মের কাছে বাউল সম্রাট হিসেবে গণ্য হয়েছেন।
শাহ আবদুল করিম এখন শুধু বাংলাদেশেই চর্চার বিষয় নয়, এখন পৃথিবী ব্যাপী আলোচনায় আছেন ভাটির পুরুষ কালনীর ঢেউয়ে বেড়ে উঠা এই মহাজন। ইতিমধ্যে তাঁর ১০টি গান বাংলা একাডেমি কর্তৃক ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে এবং তাঁর গান নিয়ে আরো কাজ চলছে। তার রচিত দেড় হাজার গানের মধ্যে সংগ্রহে আছে মাত্র ৬শ’।
শাহ আবদুল করিমের কিছু জনপ্রিয় গান সমূহঃ
- গাড়ি চলে না চলে না
- কেনে পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু
- প্রাণনাথ ছাড়িয়া যাইওনা মোরে
- আগের বাহাদুরি এখন গেল কই
- সখি কুঞ্জ সাজাওগো
- তুমি বিনে আকুল পরাণ
0 মন্তব্য(গুলি)