ARTCELL

অন্যসময়ের অনিকেত প্রান্তরে এক বিশুদ্ধ আবেগের নাম | আর্টসেল ব্যান্ড

আর্টসেল এমন একটা ব্যান্ড যাদের গানের কথাগুলো খুব মোহনীয়, গানের কথায় জীবন আছে, যৌবন আছে, প্রেরণা আছে, ভালোবাসা আছে। আমাদের জীবনের ঘাত প্রতিঘাত বা অস্তিত্বহীণতায় ভোগা কিংবা বিষণ্ণতায় ডুবে থাকা  অথবা করিডোর ধরে বিষণ্ণ মনে একা একা হেঁটে যাওয়া মানুষের জন্য আর্টসেলের গানে আছে জীবনকে হাতের মুঠোয় পুরে যেমন ইচ্ছে তেমন করার আহবান। আর্টসেল একটা শুধু নিছক ব্যান্ড নয়, আর্টসেল একটা শিল্প। শুধু গানের লিরিক্স না, আর্টসেল তাদের গানের সুরে কম্পোজিশনে তথা যন্ত্রসংগীতে মানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলতে পারবে। কিছুদিন আর্টসেল শুনতে থাকলে মনে হবে তাদের গানের সুরও যেন কিছু বলতে চায়।
যদি বলা হয়, আর্টসেল কেনো এত জনপ্রিয়? কারণ আর্টসেল জনপ্রিয়তার যোগ্য। স্রেফ হু হা করে, দু-চারটে সস্তা আবেগী গানের কথা লিখে মার্কেট পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু এ সমাজের যে বিরাট অংশটি গভীর জীবনবোধ আর গভীর আবেগের প্রতি স্পর্শকাতর, সে অংশটির অকুন্ঠ সম্মান পাওয়া যায় না।
প্রেম, দ্রোহ, বিপ্লব, জীবন ও যৌবন - আর্টসেল হল এই শব্দগুলোর মিলিত রূপ।
Artcell Band আর্টসেল ব্যান্ড
Artcell Band | 20YearsOfArtcellism Concert 
আর্টসেল ব্যান্ড গঠনের ইতিকথাঃ

স্কুল পড়ুয়া চার বন্ধুর সম্মিলিত প্রয়াস আজকের এই আর্টসেল। বলছিলাম লিংকন, এরশাদ, সেজান, সাজু'র কথা। আর্টসেলের এই চার ব্যান্ড মেম্বাররা ঢাকার এক স্কুলে একসাথে পড়তেন। কেবল এরশাদ তান্ত্রিক ব্যান্ডের মেম্বার ছিলো, তারপর লিংকন সেই ব্যান্ডটিতে যোগদান করে কিন্তু এর কিছুদিন পর ই তান্ত্রিক ব্যান্ড ভেঙে যায়। ফলাফল তান্ত্রিক ব্যান্ড ভেঙে যাওয়ায় ব্যান্ডের অন্যান্য মেম্বাররা গ্রুপ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর 'এরশাদ এবং লিঙ্কন' একজন বেসিস্ট ও একজন ড্রামার খুঁজতে থাকেন এবং এরপর তারা বেজিস্ট হিসেবে সেজান এবং ড্রামার হিসেবে সাজুকে পেয়ে যান। প্রথমদিকে এরা বিভিন্ন প্রোগ্রামে ইংলিশ ব্যান্ড মেটালিকার গান কভার করতো, দর্শকদের কাছ থেকে বেশ ভালো একটা সাড়া পাওয়ার পর তারা চিন্তা করে তাদের নিজস্ব একটা ব্যান্ড গঠনের। কিন্তু নাম?? অনেক নাম ভাবার পর শেষ অব্দি এরশাদের দেওয়া 'আর্টসেল' নামটাই সিলেক্ট করা হলো এবং ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসের ২৩ তারিখ আর্টসেল অফিসিয়াল ভাবে আত্মপ্রকাশ করে, যেন এ এক আরেক মহাকাব্যের সূচনা। আর্টসেল... মানে শিল্পকোষ। সেই সময়ে শুরুর দিকে আর্টসেল একটি আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এটি দেশের প্রথম সারির অন্যতম জনপ্রিয় মেইনস্ট্রীম ব্যান্ডে পরিণত হয়েছে। 
এক ইন্টারভিউতে ব্যান্ডের নাম আর্টসেল রাখার কারণ প্রসঙ্গে জিগ্যেস করা হলে তাদের বক্তব্য- "যদিও আমরা হেভি মেটাল ব্যান্ড হিসেবে শুরু করেছিলাম, তবু হেভি মেটাল নাম চাইনি। আমরা হেভি মেটাল এর সাথে একটা কোমল এবং শৈল্পিক ছোঁয়া চেয়েছিলাম। ‘দেহকোষ যেখানে শিল্প সৃষ্টি হয়’- এটাই আমাদের ব্যান্ডের নামকরণের পেছনে মূল আইডিয়া ছিল। এরশাদ আর্টসেল নামটা সাজেস্ট করে এবং আমরা সকলে তা সমর্থন করি।"

আর্টসেল লাইনআপঃ (অরিজিনাল লাইনআপ)

লিংকন ডি কস্তা - ভোকাল ও গিটারিস্ট
এরশান জামান - লিড গিটার
সাইফ আল নাজি সেজান - বেজ গিটার
কাজী সাজ্জাদুল আশেকীন সাজু - ড্রামার

প্রয়াত তরিকুল ইসলাম  রুপক - লিরিসিস্ট
রুম্মান আহমেদ - লিরিসিস্ট

এক নজরে আর্টসেলঃ

ব্যান্ড গঠনঃ ২৩ অক্টোবর ১৯৯৯
প্রথম সিঙ্গেল গানঃ অদেখা স্বর্গ
প্রথম এ্যালবামঃ অন্যসময় (২০০২)
দ্বিতীয় এ্যালবামঃ অনিকেত প্রান্তর (২০০৬)

এরপর প্রায় ১০ বছর পর আর্টসেল ২০১৬ সালে তাদের নতুন গান "অবিমৃষ্যতা" মুক্তি দেয়। এরপরে নিজেদের মধ্যকার কিছু সমস্যার কারণে ব্যান্ডের বাকি তিন সদস্য লিড গিটারিস্ট এরশাদ জামানের সাথে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। আর এভাবেই আর্টসেলের চার সেলের মধ্যে একজনের বিদায় হয়। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে কাজী ফয়সাল আহমেদ লিড গিটারিস্ট হিসেবে যোগদান করেন।
Artcell Band Member আর্টসেল ব্যান্ড সদস্য
ডান থেকে- লিংকন, এরশাদ, সেজান, সাজু | ছবিঃ সংগৃহীত
অন্যসময় (২০০২) ঃ

১. "অন্য সময়"
২. "ভুল জন্ম"
৩. "পথ চলা
৪. "রূপক (একটি গান)"
৫. "মুখোশ"
৬. "রাহুর গ্রাস"
৭. "ইতিহাস ( সময় ও অদৃষ্ট)"
৮. "কৃত্রিম মানুষ"
৯. "অবশ অনুভূতির দেয়াল"
১০. "অলস সময়ের পাড়ে"

জি-সিরিজ থেকে ২০০২ সালে দেশ সেরা মেটাল ব্যান্ড আর্টসেল প্রকাশ করে তাদের প্রথম অ্যালবাম হল "অন্য সময়"। এই অ্যালবামটি হেভি মেটাল শ্রোতাদের দ্বারা অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল। এই অ্যালবাম বাংলাদেশে প্রগতিশীল মেটাল ব্যান্ড সঙ্গীত জগতে দারুন বিকাশে সাহায্য করেছে।
অন্যসময় এ্যালবামে মোট গানের সংখ্যা ১০টি যেখানে আর্টসেলের ভোকাল লিঙ্কন "রাহুর গ্রাস" গানটি লিখেছিল; "কৃত্রিম মানুষ" গানটি লিখেছিল বেজিস্ট সেজান; "অবশ অনুভুতির দেয়াল" গানটি লিখেছিল এরশাদ। "ভুল জন্ম" গানটির লেখক তরিকুল ইসলাম রূপক কিন্তু তার আরেকটি লেখা গান "পথ চলা গানটির অর্ধাংশ লেখার পর সম্পূর্ণ করতে পারেনি রূপক, তার আগেই ২০০২ সালের ১৩ই জানুয়ারী দুর্লভ "সেলেব্রিয়াল ম্যালেরিয়া"য় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন প্রতিভাবান এই গীতিকার, পরবর্তীতে "পথচলা" গানের বাকি অংশ শেষ করেন আর্টসেলের আরেক শক্তিমান লিরিসিস্ট রুম্মান আহমেদ এবং বাকি পাঁচ গান লিখেছিল রুম্মান আহমেদ ই। উল্লেখ্য, অন্যসময় অ্যালবামটি রুপককে উৎসর্গ করা হয় এবং তাঁর স্মরণে অ্যালবামের চতুর্থ ট্র্যাকের নাম "রুপক (একটি গান)" দেয়া হয়।

অনিকেত প্রান্তর (২০০৬) ঃ

১. "লীন"
২. "স্মৃতিস্মারক"
৩. "ধূসর সময়"
৪. "পাথর বাগান"
৫. "শহীদ সরণি"
৬. "ছায়ার নিনাদ" (Instrumental)
৭. "ঘুনে খাওয়া রোদ"
৮. "তোমাকে"
৯. "গন্তব্যহীন"
১০. "অনিকেত প্রান্তর"

আবারো জি-সিরিজ থেকে ১লা এপ্রিল ২০০৬ সালে আর্টসেল প্রকাশ করে তাদের দ্বিতীয় এ্যালবাম "অনিকেত প্রান্তর"। এ অ্যালবামটিও বিশেষ করে তরুন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং ২০০৬ এর সর্বাধিক বিক্রিত অ্যালবামগুলোর একটি হয়। ‘অনিকেত প্রান্তর’ অ্যালবামটিতেও ১০টি ট্র্যাক রয়েছে। আমি ভুল না হয়ে থাকলে এই এ্যালবামের সবগুলো গান ই লিখেছে অসম্ভব রকমের প্রতিভাবান লিরিসিস্ট "রুম্মান আহমেদ" যিনি কিনা শুধু আর্টসেলের গানই লিখে গেছে। যার জন্য আমরা পেয়েছি আর্টসেলের অসম্ভব রকমের দুর্দান্ত লিরিক্স সংবলিত গান। আর্টসেলে এই মানুষটার অবদান শ্রদ্ধা কিংবা কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করি। এত আবেগ জড়ানো মোহনীয় শব্দগুচ্ছের শব্দভাণ্ডারের অলঙ্কিত লিরিক্স আর আর্টসেলের নিজস্ব ধাঁচের নিখুঁত কম্পোজিশন এই এ্যালবামের প্রত্যেকটা গানকেই অসাধারন করেছে। এই এ্যালবামের শেষ গান বা টাইটেল ট্র্যাক 'অনিকেত প্রান্তর' গানটিকে তো বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির 'জাতীয় সংগীত' বলা হয়। ‘অনিকেত প্রান্তর’ শব্দটির অর্থ ‘No mans land’ এক সাক্ষাৎকারে গানটি নিয়ে ব্যান্ডের ভোকাল ও রীফ প্লেয়ার লিঙ্কন ডি’কস্টা বলেছিলেন- "মানুষ আপাত স্বাধীন হলেও স্বাধীনভাবে সে যে তার প্রতিটি স্বপ্নকেই বাস্তবায়িত করতে পারে না। কেবল অনিকেত প্রান্তরে দাঁড়িয়েই তার পক্ষে নিজের স্বপ্নগুলোকে স্বপ্নে হলেও এক ধরণের বাস্তবতায় রূপ দিতে পারে। বাস্তবে হয়তো সেগুলো স্বপ্নের দলা পাকানো বাসি কবিতা, নষ্ট গান হয়েই ঝরে যায়।"

মিক্সড অ্যালবাম এ আর্টসেলের গানঃ
 
গানের নাম   -   এ্যালবাম নাম
১. অদেখা স্বর্গ - ছাড়পত্র
২. অপ্সরী - অনুশীলন
৩. দুঃখ বিলাস  - অনুশীলন
৪. এই বিদায় - Live Now
৫. উৎসবের উৎসাহে - Underground
৬. আশীর্বাদ  - দিন বদল
৭. ছেঁড়া আকাশ  - লোকায়ত
৮. অস্তিত্বের দিকে পদধ্বনি - আগন্তুক ১
৯. চিলেকোঠার সেপাই - আগন্তুক ২
১০. বাংলাদেশ স্মৃতি এবং আমরা - আগন্তুক ৩
১১. হুঙ্কারের অপেক্ষায় - গর্জে ওঠো বাংলাদেশ
১২. কান্ডারি হুঁশিয়ার (নজরুল সঙ্গীত) - Rock 303
১৩. কারার ঐ লৌহ কপাট (নজরুল সঙ্গীত) - Riotous 14 
১৪. অভয় - Single Track

Upcoming 3rd Album Track:

১. "স্পর্শের অনুভূতি"
২. "অবিমৃষ্যতা"
৩. "প্রভু"
৪. "সংশয়"

বাংলাদেশের প্রথম দিককার প্রোগ্রেসিভ রক/মেটাল ব্যান্ড আর্টসেল। আর্টসেল মূলত রক জেনারের গান করে থাকলেও এদের বেশ কিছু এক্সপেরিমেন্টাল গ্রাঞ্জ এবং থ্র্যাশ জেনারের ট্র্যাক রয়েছে। 
১৯৯৯ সালে আর্টসেল ব্যান্ড প্রতিষ্ঠা কিংবা ব্যান্ড গঠনের পর থেকে এখন ২০২১ অব্দি এই ব্যান্ডটির ২২ বছরের এই দীর্ঘ যাত্রাটা মোটেই মসৃণ ছিল না। প্রথম অ্যালবামের কাজ চলাকালীন সামনে আসে একটি বিরাট ধাক্কা, লিরিসিস্ট রুপকের হটাত মৃত্যু; এরপর দ্বিতীয় এ্যালবাম বের হবার বেশ কয়েক বছর পর সেজান আর সাজুর বিদেশ চলে যাওয়া এরপর এরশাদের ব্যান্ড ছেড়ে দেওয়া এদিকে তৃতীয় এ্যালবামের ঘোষণা বহু আগেও দিলেও প্রায় ৯ বছর হতে চললো তৃতীয় এ্যালবামের দেখা নেই। আমাদের মত হাজার হাজার আর্টসেলপ্রেমিদের কাছে সম্বল বলতে কেবল দুটো একক অ্যালবাম ও মিশ্র অ্যালবামগুলোর কয়েকটা গান। সে যাইহোক ,বিগত পনেরো বছর ধরে বের হচ্ছে না ব্যান্ডটির নতুন কোনো অ্যালবাম তারপরেও শ্রোতাদের নিকট কখনও অস্তিত্ব সংকটে পড়েনি ব্যান্ডটি। এখনও আমরা আর্টসেলপ্রেমীরা সেই দুটো অ্যালবাম ও মিশ্র অ্যালবামের গানগুলোই দীর্ঘ সময় যাবৎ আঁকড়ে ধরে রয়েছি। আর্টসেলের কনসার্ট মানেই তুমুল দর্শকের উপচ পড়া ভীর, কনসার্টের আয়োজনে লাইনআপে আর্টসেল থাকলেই সেই কনসার্ট জমিয়ে তুলতে আর্টসেল ফ্যানদের তুলনা হয়না। এদিকে ২০১৯ সালে ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত বাংলা ব্যান্ড জগতের ইতিহাসে ঐতিহাসিক হয়ে থাকা  "20YearsOfArtcellism" কনসার্টে আর্টসেল ফ্যানরা বুজিয়ে দিয়েছে আর্টসেলের প্রতি তাদের ভালোবাসা সত্য এবং পরিষ্কার, এখনও মানুষ আর্টসেলকে বুকে ধারন করে। ব্যাক্তিগতভাবে আমার আর্টসেলের প্রিয় কোন গান নেই কারন আর্টসেলের প্রত্যেকটা গানই আমার প্রিয়।

'Artcell' কারো কাছে ৭ অক্ষরের একটা শব্দ আবার কারো কাছে ৭ আলোকবর্ষ সমান সমতুল্য। আমাদের রোজকার প্রতিদিনকার প্লেলিস্টে বেজে যায় আর্টসেল কিংবা আড্ডায় মেতে উঠে একের পর এক আর্টসেলের গানে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম, সেটাই বা কম কিসে? এটাই বুঝি বিশুদ্ধ আবেগ।

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, ব্লগ, ইন্টারনেট

Posted: Saturday, October 23, 2021
Post By: FarhaN Fahidur Rahim

Related Song Lyrics

0 মন্তব্য(গুলি)